ডেঙ্গু জ্বর কী? লক্ষণ ও প্রতিকার, সচেতনতা, ঘরোয়া চিকিৎসা

ডেঙ্গু জ্বরের মশাটি এদেশে আগেও ছিল, এখনো আছে, মশা প্রজননেন এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে।ডেঙ্গু জ্বরে বেশির ভাগ আক্রান্ত হয় ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে এবং বস্তি এলাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণের হার অনেক বেশি। এটি যেমন সহজেই সেরে যেতে পারে, তেমনি সঠিক পদক্ষেপ না নিলে হতে পারে প্রাণঘাতি। তাই ভালো ভাবে বাঁচতে হলে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সচেতন হবে হবে- আমাকে, আপনাকে, সবাইকে।

ডেঙ্গু জ্বর কী?

ডেঙ্গু জ্বর হলো একটি সংক্রামক রোগ যা ডেঙ্গু ভাইরাস এর কারণে সংক্রমিত হয়। এই ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে।

ডেঙ্গু জ্বরের কারণ

ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে এবং এই ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে হয়ে থাকে।

এডিস ইজিপ্টাই মশা - ডেঙ্গু জ্বর এর ভাইরাস বহনকারী মশা

এই ভাইরাসটির চারটি ধরণ শনাক্ত হয়েছে। এর ভেতর ২ টি ধরণ ডেঙ্গু সৃষ্টি করে।

এডিস মশা কামড়ালেই কী ডেঙ্গু হয়?

না , শুধুমাত্র ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশা কামড়ালে ডে্ঙ্গুর জীবাণু দেহে প্রবেশ করে। যা ডেঙ্গু জ্বরের কারণ। একাধিক ধরণের বা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা অনেক বেশি থাকে। বর্তমানে অনেক শিশু দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক শিশুকে আবার ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আবার জটিল অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার (dengue protikar)

লক্ষণসমূহ (শুরুতেই শনাক্ত কীভাবে করবেন?) (Dengue er lokhon /dengue howar lokkhon /dengue roger lokkhon ki ki/ dengue symptoms bangla)

ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে সংক্রামণের সাধারণত ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে সাধারণ উপসর্গগুলো দেখা দেয়।

  • প্রথমে এক থেকে পাঁচ দিন হটাৎ উচ্চতাপমাত্রার জ্বর  (প্রায় ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)
  • বমি বমি ভাব
  • বমি হওয়া
  • শরীরে র‌্যাশ (উপসর্গ দেখা দেয়ার প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে ত্বকে লাল বিন্দু দেখা যায়, এই লাল লাল বিন্দু বিন্দু হয়ে থাকাকে র‌্যাশ বলে)
  • হাড়ের জোড়ায় জোড়ায় ও
  • মাংসপেশিতে প্রবল ব্যাথা ইত্যাদি হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ।

এর সঙ্গে কিছু লক্ষণ ডেঙ্গু জ্বরের বিপজ্জনক চিহ্ন হিসাবে স্বীকৃত। যেমন –

  • পেট ব্যাথা
  • অনবরত বমি করা
  • শরীরে পানি জমা
  • রাক-মাড়ি থেকে রক্তপাত
  • অতিরিক্ত দুর্বলতা
  • অস্থিরতা
  • ২ সেন্টিমিটারের বেশি লিভার বড় হওয়া
  • রক্তে হিমাটোক্রিয়েটের মান বৃদ্ধি
  • অণুচক্রিকা দ্রুত কমতে থাকা ইত্যাদি

ডেঙ্গু জ্বরের ৫ থেকে ৭ দিন সময়কালে মারাত্নক চিহ্নগুলো দেখা দিতে পারে। যেমন ডেঙ্গু শক সিনড্রম (যা ৫% ক্ষেত্রে দেখা যায়), শরীরে পানি জমা, নাড়ি দুর্বল, শরীর শীতল হওয়া, লিভারের এনজাইম এএসটি বা এএলটির মান ১ হাজার এর বেশি হওয়া, অচৈতন্য অবস্থা, হৃৎপিন্ড ও অন্যান্য অঙ্গে রোগের লক্ষণ ইত্যাদি।

When take care at home and when at hospital for Dengue Fever chart

অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ডেঙ্গু হলে –

ডেঙ্গু ভাইরাস মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে যেতে পারে। গর্ভের শেষ দিকে বা সন্তান প্রসবের সময় মা আক্রান্ত থাকলে এই সমস্যা বেশি হয়।

অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ডেঙ্গু জ্বর হলে তা মা ও অনাগত শিশুর জন্য বিশেষ ঝুঁকি বয়ে আনে। গর্ভকালে যেকোন পর্যায়ে ডেঙ্গু হলে তা মা ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য ঝুঁকিপুর্ন হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এরা ক্যাটাগরি “বি” তে পড়ে। এর অর্থ হলো তাদের জন্য বিশেষ ও আলাদা ব্যবস্থা লাগবে।

ডেঙ্গু ভাইরাস মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে যেতে পারে। বিশেষ করে গর্ভের শেষ দিকে বা সন্তান প্রসবের সময় মা আক্রান্ত হলে এ সমস্যা বেশি হয়। ফলে শিশুও আক্রান্ত হয়। আর গর্ভের প্রথম দিকে ডেঙ্গু হলে অগ্রিম গর্ভপাত হতে পারে।

আবার শেষের দিকে হলে অ্যান্টিপারটাল এবং পোস্টপারটাল রক্তপাত বেশি হতে পারে। মায়ের একলাম্পসিয়া বা প্রিএকলাম্পসিয়াও হতে পারে। এছাড়া ডেঙ্গুর প্রভাবে মায়ের অন্যান্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে লিভার ও কিডনি অকার্যকর বা শ্বাসের মারাত্মক রোগ রেসপিরেটরি অকার্যকর হয়ে যাওয়া, এআরডিএস হওয়ার মত ঘটনাও ঘটে। সব মিলিয়ে ডেঙ্গুর কারনে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মৃত্যুহার অন্যদের তুলনায় বেশি।

মাতৃগর্ভে রক্তক্ষরণ হলে গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে রক্ত সঞ্চালন কমবে। ফলে শিশুর পুষ্টি কমবে৷ এর ফলে সন্তান গর্ভে মারা যেতে পারে। বয়স অনুযায়ী আকারে ছোট বা জন্মের সময় ওজন কম হতে পারে।

ডেঙ্গুর জন্য অন্তঃসত্ত্বা মায়ের চিকিৎসা অন্য যেকোন সাধারন মানুষের মতই। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুতে পরিপূর্ণ বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পরিমান পানি এবং প্যারাসিটামলই চিকিৎসা। হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে নিবিড় পর্যবেক্ষণ লাগবে।সুযোগ থাকলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সব মাকেই হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। মেডিসিন, গাইনী ও দরকারমত অন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি টিমের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। মায়ের পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও গর্ভস্থ শিশুর সার্বিক অবস্থা নিরূপন করতে হবে। রুটিন রক্তপরীক্ষা (হিমোগ্লোবিন, হিমাটোক্রিট, এসজিপিটি প্লাটিলেট, পিসিভি) করতে হবে। বাড়তি থাকলে বারবার গুরুতর ডেঙ্গুর উপসর্গ বা ওয়ার্নিং সাইন দেখা দিচ্ছে নাকি তা লক্ষ রাখতে হবে। রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজন পুরো ব্যপারটা নিয়ে প্রথম দিন থেকেই সতর্ক থাকবেন।কারন যেকোন সময় বিপদ ঘটতে পারে।

ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে লেবার, সিজার বা অন্যকোন ইন্টারভেনশন না করে সামান্য দেরি করাই ভালো ডেঙ্গু শক এড়ানোর জন্য। সন্তান প্রসব বা ডেলিভারির সময় রিটেইনড প্লাসেন্টা ও পিপএইচ বা প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে। ডিআইসি ও শক সিনড্রোম হওয়ার ঝুঁকি অনেক। ডেঙ্গুর জন্য মায়ের গর্ভপাত বা অগ্রিম ডেলিভারি করানোর দরকার নেই।

 এ সময় যারা মা হচ্ছেন তারা বিশেষভাবে সতর্ক থাকবেন। ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য মশার কামড় ঠেকাতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জন্য উপযোগী ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চলছে। মায়ের দুধে ডেঙ্গু ছড়ায় না, তাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মা নিরাপদে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন।

প্রতিকার কীভাবে করবেন?

  1. শিশুর জ্বর হওয়ার প্রথম ২৪ ঘন্টার মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মৌসুমি জ্বর ভেবে সময়ক্ষেপন করা যাবে না। দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই ডেঙ্গু এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে হবে।
  2. জ্বর নেমে যাবার ২৪ ঘন্টা পর যদি রোগী অসুস্থতা অনুভব করে , তবে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা জরুরি। প্রয়োজনে রক্ত বা প্লাজমা  সঞ্চালন এবং ডেঙ্গু শক  সিনড্রমের বিশেষ চিকিৎসা নিতে হবে। মনে রাখবেন, জ্বর নেমে যাবার পরই আসলে জটিলতা শুরু হয়।
  3. যথাযথ চিকিৎসাসেবা  পেলে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুহার মাত্র ১%, কিন্তু শক দেখা দিলে তা বেড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

এখনো বৈশ্বিকভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী মশার কামড় থেকে বাঁচার নানা ব্যবস্থা নেওয়া। যেমন-

  • শিশুকে ফুল শার্ট, ফুল প্যান্ট ও মোজা পড়ানো।
  • দিনের বেলাও মশারি টানিয়ে ঘুমানো।
  • বাড়ি ও বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
  • ড্রেনে কেরোসিন বা মশকী নিধন কীটনাশক স্প্রে করা ইত্যাদি।
Dengue fever er protikar o protirodh chart

ডেঙ্গু রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা

  • ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে বিশ্রাম নিতে হবে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। শরীরে জলীয় অংশ বেশি থাকলে মাথাব্যথা ও পেশি ব্যথা কম হবে।
  • ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়। তাই প্লাটিলেট বাড়ে এমন খাবার খেতে হবে। যেমন- সাইট্রাস ফল, কাঠবাদাম, দই, সূর্যমুখী বীজ, গ্রিন টি, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলি, পালংশাক, আদা, রসুন ও হলুদ।
  • পেয়ারার শরবত পান করা যেতে পারে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই পানীয়টি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে ডেঙ্গু সংক্রমণ উপশম করবে।
  • রক্তের প্লাটিলেট বাড়াতে নিম পাতার রস ভালো কাজ করে। এটি শ্বেত রক্তকনিকার সংখ্যাও বৃদ্ধি করে। নিম পাতার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর গুণও আছে।

ডেঙ্গু বিষয়ক সচেতনতা মূলক স্লোগান

সচেতন হবো, রাখব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ,
সবাই মিলে গঠব ডেঙ্গু মুক্ত বাংলাদেশ।

ডেঙ্গু জ্বর কত দিন থাকে?

ডেঙ্গু জ্বর ১-২ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে।